বিডি নিউজ২৩: নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নে অবস্থিত প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে চনপাড়া বস্তি। মাদকের ডিপো যেন নারায়ণগঞ্জের চনপাড়া বস্তি। ২৪ ঘণ্টা প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে মাদক। সেখানে খুব সহজলভ্য হওয়ায় ঢাকাসহ আশপাশের এলাকা থেকে চনপাড়ায় ভিড় জমায় মাদকসেবীরা। বস্তির নয়টি ওয়ার্ডের অন্তত ১১৪টি স্পটে বিক্রি হয় মাদক। আর এই বাণিজ্যে জড়িত কয়েকশো মাদক কারবারি। এলাকাবাসীর অভিযোগ স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির ছত্রছায়ায় বছরের পর বছর ধরে চলছে মাদক বাণিজ্য।
সেখানে রয়েছে সোয়া এক লাখ লোকের বসবাস। বস্তির ছোট ছোট টিনের ঘর, পাকা-আধাপাকা দালানে লুকানো রয়েছে ‘রহস্য’। এই বস্তিজুড়ে রয়েছে আড়াইশ মাদকের স্পট। বস্তিবাসীদের বেশিরভাগই ব্যস্ত সময় কাটে মাদক, অস্ত্র বেচাকেনায়। সেখানে প্রমোদের জন্য রয়েছে চারটি স্পট। চলে অসামাজিক কার্যকলাপ। অভিযোগ উঠেছে, এসবের নিয়ন্ত্রণ করে চনপাড়া কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার ও প্যানেল চেয়ারম্যান মো. বজলুর রহমান এবং রাশেদুল ইসলাম শাহিন ওরফে সিটি শাহিন। সম্প্রতি সিটি শাহিন র্যাবের অভিযানে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। এখানে প্রতিপক্ষ যেই হোক, সবাই বজলু মেম্বারের লোক। বজলু চনপাড়া বস্তি থেকে প্রতিদিন চাঁদা আদায় করেন সাড়ে চার লাখ টাকা। চাঁদার টাকায় দুজন গানম্যান নিয়ে চলেন বজলু। বন্দুকের ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় করে তার লোকজন। আর কেউ চাঁদা না দিলে তার কপালে নেমে আসে নির্যাতনের খড়্গ। এসব আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত এক-দেড় বছরে নিহত হয়েছেন ছয়জন।
সরেজমিন দেখা যায়, রূপগঞ্জের চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ। বস্তিতে নতুন কেউ প্রবেশ করতেই নজরে আসে বস্তিবাসীর। দুপুর গড়াতেই মোটরসাইকেলে বেড়ে যায় মাদক সেবন-ব্যবসায়ীদের আনাগোনা। মূলত ওই মাদক কারবারিদের শেল্টারদাতা বজলু মেম্বার ও সিটি শাহিন।
বস্তির এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বজলু মেম্বারই এখানকার হর্তাকর্তা। বস্তির যত নিয়ম-কানুন সবই করেন বজলু। তার কথার বাইরে কেউ গেলে তার জীবনে নেমে আসে নির্যাতন-নিপীড়ন। তার কথার বাইরে গেলে তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে হত্যা করে লাশ ফেলে দেওয়া হয় শীতলক্ষ্যায়। তার বিরুদ্ধে হত্যা, মাদক ও ধর্ষণসহ ১৬টি মামলা ছিল। অবৈধ অর্থের জোরে বেশিরভাগ মামলাই তদন্তকারীর মাধ্যমে শেষ করে দিয়েছেন তিনি। এখনও তিন-চারটি মামলা রয়েছে তার ঝুলিতে।’ এগুলোও শেষ করার পর্যায়ে বলে এলাকাবাসী সূত্র জানায়।
এলাকার এক অটোরিকশাচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘চনপাড়ার ৮ নম্বরের বাসিন্দা মনুর বাসায় বসে চলে অসামাজিক কার্যকলাপ। সঙ্গে থাকে মাদকের আসর। মনু মাঝেমধ্যে ভোরে চনপাড়া থেকে চার-পাঁচজন তরুণীকে অটোরিকশায় করে রূপগঞ্জের নাওরা এলাকায় নিয়ে যান। দিনভর থাকার পর আবার ফিরে আসেন বাসায়। তার বাসাতেই চলে রঙ্গলীলা। মেম্বার বজলু ও সিটি শাহিনের লোকজনের আনাগোনা মনুর বাসায় বেশি। মনুর বাসায় সুন্দরী নারীদের দিয়ে ফাঁদে ফেলে আদায় করা হয় লাখ লাখ টাকা।
চনপাড়ার এক বাসিন্দা বলেন, চনপাড়ায় মাদক কেনাবেচাসহ বিভিন্ন কারণে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এক পক্ষের সঙ্গে আরেক পক্ষের দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান। মাঝেমধ্যেই মারামারি হয়। তবে মাদক কারবারি যে-ই হোক, কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের (চনপাড়া এলাকা) মেম্বার বজলুর রহমানকে চাঁদার টাকা দিতেই হবে। তাকে টাকা না দিয়ে কারও ব্যবসা চালানোর উপায় নেই।’
স্থানীয় সূত্র মতে, ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহায়তায় চানপাড়ায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার লোক এখানে বাস করে। দীর্ঘদিন যাবৎ এই চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রে তারা বসবাস করে। অনেকে চনপাড়া রেকর্ডগুলো কিনে নিয়েছে। প্লটগুলো বরাদ্দ করা ছিল ১২ হাত ১৬ হাত। অনেকে প্লট কিনে এখানে এসেছে। এখানে মূলত গার্মেন্টস কর্মীর সংখ্যা অনেক বেশি।
বজলুর ২৫০টি মাদকের স্পট: স্থানীয় সূত্র জানায়, এই বস্তিতে ভালো মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। কিন্তু মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা ও অসামাজিক কার্যকলাপের কারণে অনেকেই চলে গেছেন। এখন পুরো বস্তি ঘিরেই মাদক ও অসামাজিক কার্যকলাপের রমরমা ব্যবসা। বর্তমানে চনপাড়া বস্তিতে রয়েছে ২৫০ মাদকের স্পট। আর অসামাজিক কার্যকলাপের স্পট রয়েছে চার-পাঁচটা। এখানে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার একমাত্র বজলুরই।
সূত্র জানায়, বজলু একটি স্কুলের শিক্ষিকাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধর্ষণ করে। এরপর বিয়ের জন্য চাপ দিলে তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এর পর ভয়ে ওই শিক্ষিকা আর স্কুলে আসেননি। কথা হয় বস্তির এক তরুণের। তার বক্তব্যের প্রমাণ রয়েছে সময়ের আলোর কাছে। ওই তরুণ বলেন, ‘বজলু বিভিন্ন সময় একজনকে অন্যজনের বিরুদ্ধে উসকে দেন। বজলুর অবৈধ পথে টাকা ইনকামের কালেকশনের দায়িত্ব ছিল সিটি শাহীন (র্যাবের অভিযানে নিহত)। পরে শাহিন আস্তে আস্তে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চনপাড়া বস্তিতে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলে। তাদের কাছে দেশীয় অস্ত্রের পাশাপাশি কাটা রাইফেল, ৯ এমএমসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র রয়েছে।
তিনি বলেন, ওই বস্তিতে যারা মাদক বিক্রি করে তার বাড়িতে মাদকের কিছুই পাওয়া যাবে না। তারা মাদক রাখে অন্যের বাড়িতে। তারা এমন বাড়িতে মাদক রাখে যে ব্যক্তি রিকশা চালায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সে বাড়িতে অভিযান চালালেও মাদকের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে যার বাসায় মাদক রাখা হয় সে কিছুই বলতে পারে না ভয়ে।
তিনি বলেন, ‘বজলুর রহমানের তিন ভাই। এর মধ্যে বোতল মিজু, পাউডার হাসান, গুটি কাওসার। তারা বজলুর আপন তিন ভাই। ব্যবসায়িক ট্যাগের কারণে তাদের নাম এ রকম হয়েছে। ফেনসিডিলের ব্যবসার কারণে বোতল মিজু, হিরোইনের ব্যবসা করার কারণে পাউডার হাসান ও ইয়াবার ব্যবসা করার কারণে গুটি কাওসার নামে এলাকায় পরিচিত। এদের ছাড়া কেউই মাদক কেনাবেচা করতে পারবে না।’
বজলুর কুখ্যাত সন্ত্রাসী বাহিনী: নদীর ওই পারে রূপসী এলাকায় বজলুর লোকজন রয়েছে। বজলুর ওই পারে ব্যবসা রয়েছে। মিল্লাত, মোস্তফা ও জান শরীফ-এরা রূপসী, ইছাখালী ও বরালো এলাকায় পাইকারি হারে ইয়াবা ও ফেনসিডিল সরবরাহ করে। চনপাড়া লোকজন ভয় পাওয়ার কারণে ওদের কাছ থেকে মাদক নিতে বাধ্য।
ওই সূত্র আরও জানায়, বস্তিতে চারটি অসামাজিক কার্যকলাপের স্পট রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো মনু। ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে মনুর বাসায় নিয়ে এসে মেয়েদের দিয়ে দেহ ব্যবসা করানো হয়। এ ছাড়াও ফেসবুক বা বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে পরিচিত হয়ে তাদের সঙ্গে অবৈধ কাজ করে। পরে তাদের ডিমান্ড অনুসারে টাকা দিতে ব্যর্থ হলে মারধর করা হয়।
চনপাড়ায় মনুর এই অপকর্মে কেউ যদি রাজি না হয় তাহলে তাকে বেদম মারধর করা হয়। নির্যাতনের পর বাধ্য করা হয় এই কাজে। মনুর আস্তানায় যারা আসবে তাদের ফাঁদে ফেলে মনু। এর পর খবর দেওয়া হয় বজলুর লোকজনকে। মেয়েদের সঙ্গে থেকে আপত্তিকর ছবি তোলে এবং বড় অঙ্কের টাকা দাবি করে।
এ বিষয়ে জানতে গতকাল বজলু মেম্বারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
চনপাড়া বস্তির বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন সময়ের আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন যাবৎ চনপাড়া বস্তিতে মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রমের খবর পাই। সেখানে অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতো আমরা অভিযান চালাই। সম্প্রতি র্যাব মাদক ও অবৈধ অস্ত্রবিরোধী অভিযানে যায় চনপাড়া বস্তিতে। এ সময় সন্ত্রাসীরা র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। পরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে সিটি শাহিন গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। বজলু মেম্বার ও শাহিনের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের কাছেও এ ধরনের অভিযোগ এসেছে। আমরা যাচাই করে দেখছি।