শহর বানু। ছবিটি মঙ্গলবার রাতে নারায়ণগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সড়কে তোলা শহর বানু। ছবিটি মঙ্গলবার রাতে নারায়ণগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সড়কে তোলা
গতকাল মঙ্গলবার রাত একটা। ব্যস্ত শহরের কোলাহল কমেছে। ঈদের আগে মধ্যরাত পর্যন্ত খোলা রাখা বিপণিবিতানগুলোও একে একে বন্ধ হচ্ছে। বেশির ভাগ মানুষ ফিরে গেছেন যাঁর যাঁর গন্তব্যে। যাঁরা এখনো ফেরেননি, তাঁদের হাঁটাচলায় তাড়াহুড়োর ছাপ।
বাড়ি ফেরা সেসব মানুষের চেয়ে শহর বানুর (৫৫) ব্যস্ততা যেন আরও একটু বেশি। শহরের প্রধান সড়কের ফুটপাত ধরে হেঁটে যাওয়া প্রায় প্রতিটি মানুষের কাছে দৌড়ে যান তিনি। হাতে থাকা একগুচ্ছ বেলি ফুলের মালা পথচারীদের সামনে এমনভাবে এগিয়ে ধরেন যেন ফুলের ঘ্রাণ তাদের নাক পর্যন্ত পৌঁছায়। একরকম পথ আগলে ধরেই পথচারীদের অনুরোধ করেন বৃদ্ধা, একটা ফুল লইয়া যাও।
গতকাল মধ্যরাতে নারায়ণগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কে শহর বানুর সঙ্গে দেখা। এক তরুণের পথ আগলে অনেকটা আদেশের সুরেই বলছিলেন বেশি রাত করে বাড়ি ফিরলে ঘরে থাকা স্ত্রীর জন্য যেন অবশ্যই ফুল নিয়ে যান তিনি! বৃদ্ধার এমন কথায় হাসতে হাসতেই তরুণ উত্তর দেন, ‘চাচি, অভাবের ঘরে ফুলের চেয়ে ভাতের কদর বেশি।’ তরুণের কাছে ফুলের কদরও কম মনে হলো না। ২০ টাকায় দুটি মালা কিনে চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণ নেন একবার। তারপর হাঁটা দেন নিজের গন্তব্যে।
শহর বানুর সঙ্গে কথা বলতে গেলে পাত্তা দেন না। এড়িয়ে যান। বিরক্তি নিয়ে নানা কথা বলেন। এখনো নয়টা মালা অবিক্রীত। সেগুলো বিক্রি না হলে বাড়ি ফেরা যাবে না। শহরের মানুষ দিন দিন কৃপণ হয়ে যাচ্ছে। কেউ আর এখন ফুল কিনতে চায় না। এমন নানা কথা। ফুল না কেনার কারণ জানতে চাইলে এবার কিছুটা আগ্রহ নিয়েই কথা বলেন বৃদ্ধা। ‘কেমনে কিনব? পকেটে টেকা থাকতে অইব না? জিনিসপত্রের যা দাম। খাওন কিনব না ফুল কিনব?’ এমন সব প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে এবার এই প্রতিবেদকের সামনেই ফুলের গুচ্ছ এগিয়ে ধরেন। ‘নেও, ফুল কেনো।’
কথা জমে বৃদ্ধার সঙ্গে। নাম জানা হয়। জানা হয়, ৪৭ বছরের শহর জীবনের গল্প।
ভোলার চরফ্যাশনে জন্ম। বাবা নাম রেখেছিলেন শহর বানু। বড় বোন ফুল বানু। সাত বছর বয়সে বাবার মৃত্যুর এক বছর পর নারায়ণগঞ্জ শহরে আসেন। শহরের বড় ঘরে আয়ার কাজ করা ফুল বানু ছোট্ট শহর বানুকেও গৃহকর্মীর কাজে লাগিয়ে দেন। বৃদ্ধার ভাষায়, ‘বড় ঘরে ছোট মনের মানুষ’দের নির্যাতনে তিনি কাজ ছাড়েন। কাজ নেন কুমুদিনী পাট বেলিং প্রেসে। জীবনের দীর্ঘ সময় সেখানেই কাজ করেছেন অনিয়মিত শ্রমিক হিসেবে। এর মধ্যে বিয়ে হয় মুন্সিগঞ্জের মীরকাদিমে। স্বামী পাটখড়ির ঘর বানানোর শ্রমিক। কিন্তু জায়গার অভাবে নিজের একটা ঘর হয়নি কখনো। দুই সন্তান রেখে মারা যান ১৯৯৮ সালে।
নারায়ণগঞ্জ শহর সিটি করপোরেশন হওয়ার পর পাট বেলিং প্রেসে কাজ ছেড়ে সড়ক নির্মাণ শ্রমিকের কাজ শুরু করেন শহর বানু। প্রায় ১০ বছর কাজ করেন। কোভিড মহামারির সময় হঠাৎ একদিন কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে জানতে পারেন, মেরুদণ্ডে টিউমার হয়েছে। তখনই কাজ ছাড়তে বাধ্য হন।
বৃদ্ধা জানান, টিউমারের কারণে কুঁজো হতে পারেন না, চেয়ার ছাড়া ঠিকঠাক বসতেও পারেন না। চেয়ারে বসে করার মতো কাজ খুঁজে পাননি। অস্ত্রোপচার করারও টাকা নেই। দীর্ঘদিন ঘরে বসে থেকে কয়েক মাস আগে ভিক্ষা করতে বের হন। ভিক্ষার কথা বলতেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন। বলেন, ‘আজীবন কাম কইরা খাইছি। ’৯৮–এর বন্নায় যখন উনি মারা গেল, বাচ্চা দুইডা ছোট। হেই সময়ও ভিক্ষা করি নাই। হেই আমিই মানুষের সামনে হাত পাতি। মানুষ কত কথা কয়। জিগায় কাম কইরা খাই না কেন। লজ্জায় চোখ বাইয়া পানি পড়ে। কাউরে কইতেও পারি না।’
লজ্জায় হাত পাততে না পেরে শহরে ফুল বিক্রি করেন শহর বানু। প্রতিদিন গড়ে আড়াই শ টাকা আয় হয়। তাতেই খেয়ে-পরে থাকেন। বৃদ্ধার দুই ছেলে। বিয়ে করেছেন, সংসার হয়েছে। ছেলেরা দেখে না? এমন প্রশ্নে বৃদ্ধা মাথা নাড়েন, ‘না’। ‘নিজেরাই চলতে পারে না। আমারে দেখব কী?’
এবার বৃদ্ধা চলে যেতে চান। ‘৪৭ বছরের শহর জীবনে কী দেখলেন?’—জানতে চাইলে বিরক্তি আর আক্ষেপ মেশানো কণ্ঠে শহর বানু উত্তর দেন। ‘কত কিছুই না দেখলাম। গ্রাম শহর অইল, আপথে পথ অইল, অমানুষ মানুষ অইল, আন্ধার শহরে আলো আইল, এত নাকি উন্নয়ন অইল। খালি আমার উন্নয়ন অইল না। আমার উন্নয়ন কই? তথ্যসূত্র: প্রথম আলো