কুমিল্লা বুড়িচং উপজেলায় সীমান্তে চোরাকারবারী ও শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের গুলিতে নিহত সাংবাদিক মহিউদ্দিন সরকার নাঈম ছিলেন সীমান্তের তালিকাভুক্ত ও জেলার মাদক কারবারিদের জন্য পথের কাটা। মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও প্রতিবাদী একজন সাংবাদিক। তার ফেসবুক ওয়ালজুড়ে মাদক বিরোধী পোস্টগুলো দেখলেই তা সহজে বোঝা যায়।
মাদক কারবারিদের গুলিতে নিহত সাংবাদিক মহিউদ্দিন পার্শ্ববর্তী ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মালাপাড়া ইউনিয়নের অলুয়া গ্রামের সদ্য অবসর নেয়া পুলিশ সদস্য মোশাররফ সরকারের ছেলে। তিনি আনন্দ টিভির বুড়িচং ব্রাহ্মণপাড়া প্রতিনিধি হিসেবে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন। কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত দৈনিক কুমিল্লার ডাক পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার এবং বুড়িচং প্রেসক্লাবের সদস্য ছিলেন।
মহিউদ্দিন সরকার নাঈমের ফেসবুক ওয়াল ঘুরে দেখা যায়, প্রতিদিনই মাদক ও মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে একাধিক স্ট্যাটাস দিতেন তিনি। কুমিল্লাসহ বিভিন্ন এলাকায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হওয়া মাদক কারবারিদের সংবাদ ও ছবি আপলোড করতেন প্রতিনিয়ত।
নিজেই বিভিন্ন স্থানে মাদকের বিরুদ্ধে লিফলেট ও ফেস্টুন বিতরণের ছবিও রয়েছে তাঁর ওয়ালে। সরাসরি মাদক সেবন, কেনাবেচা ছবি ও ভিডিও দেখা যার তার ফেসবুকে। সহায়তা করতেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে। ইচ্ছে ছিলো ঈদের পরেই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে চাকুরীতে যোগ দেয়ার। সম্প্রতি সময়ে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের সাদেক মিয়ার ছেলে একাধিক মাদক ও অস্ত্র মামলার আসামি রাজু (২৪)কে নিয়ে তাঁর ফেসবুকে ওয়াল ও অনলাইন পোর্টালে লেখালেখি কাল হয় তার জীবনে।
গত ২৬মার্চ শঙ্কুচাইল বাজার এলাকায় কুমিল্লার শীর্ষ চোরাকারবারি ও কিশোর গ্যাং লিডার রাজু’র সাথে কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এরপরই রাজু’র নানা অপকর্ম ও মাদক নেটওয়ার্ক সম্পর্কে গোপন তথ্য সংগ্রহ করতে থাকে। হাতেনাতে রাজুকে মাদক ও মালামাল সহ গ্রেফতার করানোর জন্য চেষ্টাও করছিলো গত কয়েকদিন ধরে।
দেখা যায় গত ৯ এপ্রিল মহিউদ্দিন তাঁর ফেসবুকে রাজুর ছবি দিয়ে একটি পোস্ট দেন। সেখানে লিখেন- ‘কুমিল্লার সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে মাদক কারবারিদের দৌরত্ম্য! তালিকাভুক্ত ও চিহ্নিতদের সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন মাদক ব্যবসায়ীরা। এদের মধ্যে অন্যতম হলো রাজু, যা সবাই চিনে ভুয়া বিজিবি গোয়েন্দা সদস্য হিসেবে।
মহিউদ্দিনের ঘনিষ্ঠ এক সংবাদকর্মী জানান, মহিউদ্দিনকে চর-থাপ্পড় মারে রাজু এবং পরে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয় প্রকাশ্যে। বিষয়টি ফোন করে আমাকে জানালে থানায় অভিযোগ করতে বলি । এরপর থেকেই রাজুর নানা অপকর্মের তথ্য অনুসন্ধানে নামে মহিউদ্দিন সরকার। চোরাচালানের সাথে সম্পৃক্ততা এবং মাদক কেনাবেচার গোপন ভিডিও ধারনের চেষ্টা করতে থাকে। এর মাঝেই নিজের ফেসবুকে রাজু সম্পর্কে আরো কয়েকটি স্ট্যাটাস দেয়।
পরিবার স্বজন ও নিকটজনদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দুপুরে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা পরিষদে সংবাদ সংগ্রহের কাজ করছিলো। বিকেলে তাকে রাজু’র মাদকে চালানে বিষয়ে তথ্য আছে এবং হাতেনাতে আটক করানোর যাবে বলে কেউ একজন ফেনে খবর দেয়। খবর পেয়ে কংশনগর এলাকার পলাশ ও ময়নামতি এলাকার ফরহাদ মৃধা মনি নামে ২জনের সাথে একটি মটর সাইকেল নিয়ে সীমান্তের নগর এলাকায় গিয়ে এক যুবকের সাথে কথা বলে। সেখান থেকেই থানা পুলিশের সাথেও কয়েকবার যোগাযোগ করে। ঐ যুবককে সাথে নিয়ে মনি ও পলাশ সহ সামনে এগিয়ে গিয়ে একটি দোকানের সামনে দাড়াতেই রাজুর নেতৃত্বে জুয়েল ও খলিলসহ ২০/৩০ জনের একটি দল তাদের সামনে এসে দুটি পিস্তল বের করে মহিউদ্দিনকে লক্ষ করে ২/৩ গজ দুরে দাড়িয়ে থেকে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। এসময় মাথা বুক ও হাতে একাধিক গুলি বিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে। এসময় সাথে থাকা পলাশ ও মনি সহ তথ্য দাতা সেই যুবক সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যায় বলে জানায় পলাশ ও মনি।
এদিকে উপজেলা হাসপাতালে সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে বৃহস্পতিবার সকালে মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। দুপুরে ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ পরিবারের নিকট হস্তান্তর করে পুলিশ। পরে বাদ আসর জানাজা শেষে পারিবারিক করস্থানে দাফন করা হয় তাঁকে।
মাদক কারবারিদের গুলিতে সাংবাদিক নিহতের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কুমিল্লার সাংবাদিক সমাজ সহ বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। তারা বলেন, মহিউদ্দিন সরকার মাদক ব্যবসায়ীদের মাদক চোরাচালান নিয়ে প্রতিবাদ করতেন। সম্প্রতি মাদক ব্যবসায়ী রাজু গং নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে এ নিয়ে বিরোধের জেরেই তাঁকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। হত্যাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানান সকলে।
বুড়িচং থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসেন বলেন, এ ঘটনায় পুলিশের একাধিক দল কাজ করছে। মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। বিস্তারিত পরে জানানো হবে।
উল্লেখ্য, কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের হায়দ্রাবাদ সীমান্তে মাদক কারবারির গুলিতে মহিউদ্দিন সরকার নাঈম নিহত হন। গতকাল বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
পরে মহিউদ্দিন সরকার নাঈমকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে বিজিবি সদস্যরা হায়দ্রাবাদ এলাকার দুজন যুবককে দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এ সময় বিজিবি সদস্যরা বলেন, সীমান্তে মারামারিতে আহত হয়েছেন মহিউদ্দিন নামে এক সাংবাদিক। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিতে বলে তাঁরা চলে যায়। পরে ওই দুই যুবক মহিউদ্দিন সরকারকে বুড়িচং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মুজাহিদুল ইসলাম মৃত ঘোষণা করেন।
ঘটনার পর খবর পেয়ে তৎক্ষনিক কুমিল্লা জেলা প্রশাসক কামরুল ইসলাম ও পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ সহ উর্ধতন কর্মকর্তাগন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন জানিয়ে জড়িতদের গ্রেপ্তারে একাধিক টিম কাজ করছে বলেও জানান পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ। সূত্র: (আইবিএন২৪.টিভি)